অপরিকল্পিত নগর ব্যবস্থাপনার কারণে ঢাকা শহরে অগ্নি দুর্ঘটনায় জীবন ও মাল বেশি ক্ষতিগ্রস্তের শিকার হয়। আধুনিক সভ্যতায় এসে একটি শহরের বৈশিষ্ট্য যেরকম থাকা উচিত, ঢাকা শহরের বৈশিষ্ট্য তেমনটা নেই। ঘনবসতিপূর্ণ শহর ও অপ্রশস্ত রাস্তা ঢাকা শহরের বাসিন্দাদের সাধারণ জীবনযাপন ব্যবস্থা অনেক দুরূহ করে তুলেছে। অগ্নিদুর্ঘটনার হাত থেকে জানমাল ও সম্পদ রক্ষার কার্যকর ব্যবস্থা হলো ফায়ার হাইড্রেন্ট সিস্টেম (পানি সরবরাহের উৎস)। বিশ্বের প্রায় সব শহরে অগ্নিদুর্ঘটনা রোধে এ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হলেও ব্যতিক্রম শুধু ঢাকা। জানা যায়, রাজধানীর নিমতলীর পর আগুনের বড় ধাক্কা লাগে চুরিহাট্টায়। চকবাজারের চুরিহাট্টার শোক কাটতে না কাটতেই বনানীর এফআর টাওয়ারে আগুনের ঘটনা, এরপর গুলশান। সর্বশেষ ২৯ ফেব্রুয়ারিতে বেইলী রোড়ে আটতলা ভবনের গ্রিন কোজি কটেজে আগুন লাগে। সেই আগুনে প্রান হারায় ৪৪ জন। প্রায়দিনই রাজধানীর কোথাও না কোথাও আগুন লাগছে। আগুনে শুধু মানুষ নয়; নিরাপদে থাকার স্বপ্নও পুড়ছে নগরবাসীর। একের পর এক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সবাই যেন দিশেহারা। সবচেয়ে বড় হতাশাজনক বিষয় হলো, আগুন নিয়ে সেবাদানকারী সংস্থাগুলোর কার্যকর উদ্যোগ না নেয়া।
বিশেষজ্ঞ ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা বলছেন, নিমতলী ও চকবাজারে ফায়ার সার্ভিসকর্মীরা প্রয়োজনীয় পানি সরবরাহের অভাবে দ্রুত আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেননি। একই সমস্যা লক্ষ্য করা গেছে বনানীর এফআর টাওয়ারের আগুনেও। ফলে আগুনের ব্যাপ্তি আর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেড়েছে। ফায়ার হাইড্রেন্ট থাকলে পানির সংকটে পড়তে হতো না ফায়ার ফাইটারদের।
জানা যায়, নবাবি আমলেও ঢাকায় কার্যকর পানি ব্যবস্থাপনা ছিল। ঢাকার দ্বিতীয় নবাব আবদুল গণি (১৮৩০-১৮৯৬) তার শাসনামলে বেশকিছু জনহিতকর কাজ করেন। তার মধ্যে অন্যতম ছিল ঢাকার পানি ব্যবস্থাপনা অর্থাৎ ফায়ার হাইড্রেন্ট সিস্টেম। পানি পরিশোধন করে বিনামূল্যে সেই পানি নগরবাসীর জন্য সরবরাহের ব্যবস্থা করেন তিনি। ওই পানি খাওয়া ও গোসলের কাজে ব্যবহার করতেন নগরবাসী। গত বছর এপ্রিলের শুরুতে ঢাকার বঙ্গবাজারে যখন আগুন লাগল, ঠিক পাশেই ফায়ার সার্ভিসের সদর দপ্তর থেকে অগ্নি নির্বাপক বাহিনীর প্রথম দলটি সেখানে পৌঁছে যায় দুই মিনিটের মধ্যে। কিন্তু ফায়ার ব্রিগেডের একটি গাড়ি যে পরিমাণ পানি বহন করে, তা মোটামুটি ১০ মিনিটের মধ্যে শেষ হয়ে যায়। আর বঙ্গবাজারের আগুন ততক্ষণে নরককুণ্ডে পরিণত হয়েছে।
সেই আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে ফায়ার সার্ভিসের ৪৮টি ইউনিটের সময় লাগে সাড়ে ছয় ঘণ্টা। আর পুরোপুরি নেভাতে ৭৫ ঘণ্টা সময় লেগে যায়। ততক্ষণে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স, গুলিস্তান ইউনিট, মহানগর ইউনিট, আদর্শ ইউনিট, মহানগর কমপ্লেক্স সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় এনেক্সকো টাওয়ার, ইসলামিয়া মার্কেট ও বঙ্গ হোমিও মার্কেট।
ঢাকা ওয়াসা কর্তৃপক্ষ বলছে, ঢাকায় রয়েছে তাদের ৮৬৫টি পাম্প। সবগুলো পাম্প স্টেশনেই রয়েছে ফায়ার হাইড্রেন্ট সিস্টেম। চলতি বছরেই ঢাকায় বসানো হবে কয়েক হাজার ফায়ার হাইড্রেন্ট। ফায়ার হাইড্রেন্ট হচ্ছে পানির একটি সংরক্ষণাগার। এখানে উচ্চ চাপে পানি সংরক্ষিত হয়। ফলে কাছাকাছি কোথাও আগুন লাগলে এ পয়েন্টে পাইপ লাগিয়ে সহজেই আগুন নেভানোর ব্যবস্থা করা যায়। ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) দেবাশীষ বর্ধন বলেন, রাজধানীতে প্রায়দিনই ঘটছে অগ্নিদুর্ঘটনা। অধিকাংশ সময় পানির স্বল্পতার কারণে আগুন নেভাতে বেগ পেতে হয় ফায়ার ফাইটারদের। সরু রাস্তায় পানি বহনকারী গাড়িগুলো প্রবেশ করতে পারে না। বাড়ির নিচের রিজার্ভ ট্যাংকগুলোতে পর্যাপ্ত পানি থাকে না। এছাড়া নগরীর বিভিন্ন স্থানে থাকা জলাধারগুলো ভরাট করে ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। ফলে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার সময় পানির সংকটে পড়তে হয় ফায়ার সার্ভিসের সদস্যদের। এ সংকট কাটাতে জরুরি ভিত্তিতে ফায়ার হাইড্রেন্ট সিস্টেমে যাওয়া প্রয়োজন।
রাজউকের প্রধান প্রকৌশলী (পূর্বাচল উপশহর প্রকল্পের সাবেক পরিচালক) উজ্জল মল্লিক জানান, পূর্বাচলে সড়কের পাশে ফায়ার হাইড্রেন্ট বসানোর পরিকল্পনা রয়েছে রাজউকের। সেজন্য সড়কের পাশে জায়গাও রাখা হয়েছে। তবে তা এখনই হচ্ছে না। তিনি বলেন, সেখানে পানি সরবরাহ সিস্টেমের সঙ্গে ইনবিল্ট হাইড্রেন্ট হবে। এ বিষয়টা এখানে করার সুযোগ আছে। সেজন্য ফায়ার হাইড্রেন্ট এখনও স্থাপন করা হয়নি। ফায়ার ব্রিগেড সেখানে একটা প্রকল্প করবে। রাজউক সড়কের জায়গা রেখেছে। এটা নতুন একটা প্রকল্প হবে। প্রভিশন আছে কিন্তু এই মুহূর্তে করা হচ্ছে না।
এ বিষয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. মোহসীন বলেন, ‘আমাদের মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যৌথ সভায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান ওয়াসাকে ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপনের জন্য বারবার তাগিদ দেয়া হয়েছে। বনানী ও চুরিহাট্টার পর এটার গুরুত্ব এখন আমরা সবাই অনুভব করছি। আশা করছি, সংশ্লিষ্টরা সহসা এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেবেন।’
এ বিষয়ে ঢাকা ওয়াসার পরিচালক (টেকনিক্যাল) এ কে এম শহিদ উদ্দিন বলেন, ঢাকা শহরে আমাদের ফায়ার হাইড্রেন্ট নেই, এমন নয়। ঢাকায় আমাদের ৮৬৫টি পাম্প স্টেশন আছে, সেখানেও এ সিস্টেম আছে। তবে তা পর্যাপ্ত নয়। অগ্নিঝুঁকিতে থাকা এলাকায় এটি সবসময় কার্যকরও নয়। তিনি বলেন, শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক কিংবা এলাকা এবং মার্কেট সংলগ্ন এলাকায় ওয়াসার পক্ষ থেকে ২০০ ও ৩০০ মিটার অন্তর অন্তর একটি করে ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপন করা হবে। প্রকল্প তৈরির কাজ চলছে। আশা করা যায়, চলতি বছরেই এ কাজ শুরু হবে।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata

গুরুত্বপূর্ণ সড়ক কিংবা মার্কেট সংলগ্ন এলাকায় ওয়াসার পক্ষ থেকে ২০০ ও ৩০০ মিটার অন্তর অন্তর একটি করে ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপনের কথা থাকলেও নেই একটিও
ফায়ার হাইড্রেন্ট নেই ঢাকার রাস্তায়
- আপলোড সময় : ০৬-০৩-২০২৪ ১০:৪০:৪৪ পূর্বাহ্ন
- আপডেট সময় : ০৬-০৩-২০২৪ ১০:৪০:৪৪ পূর্বাহ্ন


কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ